৮ নভেম্বর ২০২৫ - ০৭:৫৯
যুদ্ধের ২ বছর পর গাজায় বিবিসি।

গাজায় যতদূর চোখ যায়, শুধু ধ্বংসস্তূপ আর ধ্বংসস্তূপ।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা): বিবিসি বলছে, মানচিত্র ও স্মৃতির গাজা আর নেই—তার জায়গা নিয়েছে এক রঙের ধ্বংসস্তূপ, যা এক প্রান্তে বেইত হানুন থেকে অন্য প্রান্তে গাজা নগর পর্যন্ত বিস্তৃত এক সমতল ধূসর মরুভূমির মতো


গাজার ভেতর দূরে দূরে টিকে থাকা কিছু ভবনের অবয়ব ছাড়া এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই—যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে কোথায় কোন পাড়া ছিল, যেখানে একসময় হাজার হাজার মানুষ বাস করত।

যুদ্ধের প্রথম দিকের সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েলি স্থলবাহিনী যে এলাকাগুলোয় প্রথম প্রবেশ করেছিল, এটি ছিল তার একটি। এরপর হামাস যখন ওই অঞ্চলে আবার সংগঠিত হতে শুরু করে, তখন ইসরায়েলি সেনারা একাধিকবার অভিযান চালায়।

ইসরায়েল কোনো সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে গাজা থেকে প্রতিবেদন করতে দেয় না। গতকাল বুধবার তারা বিবিসিসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন গাজার একাংশে নিয়ে যায়।

যুদ্ধের ২ বছর পর গাজায় বিবিসি।
স্যাটেলাইট চিত্রে গাজার রাফাহ এলাকা। 

এই সংক্ষিপ্ত সফর ছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত, যেখানে সাংবাদিকদের কোনো ফিলিস্তিনির সঙ্গে দেখা করার বা গাজার অন্য এলাকায় যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

ইসরায়েলের সামরিক সেন্সরশিপ আইন অনুযায়ী, প্রকাশের আগে সামরিক কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করেছেন। তবে বিবিসি এই প্রতিবেদনের সম্পাদনাগত নিয়ন্ত্রণ সব সময়ের জন্য নিজেদের হাতে রেখেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

সাংবাদিকরা যে এলাকায় গিয়েছিলেন, সেখানে ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইসরায়েলি সামরিক মুখপাত্র নাদাভ শোশানি বলেন, 'এমনটা লক্ষ্য ছিল না।'

তিনি বলেন, 'লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসীদের দমন করা। প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচে একটি করে সুড়ঙ্গ ছিল অথবা বিস্ফোরক পেতে রাখা হয়েছিল কিংবা সেখানে রকেট লঞ্চার বা স্নাইপারের অবস্থান ছিল।'

'কেউ যদি দ্রুত গাড়ি চালায়, এক মিনিটের মধ্যেই সে কোনো না কোনো ইসরায়েলি দাদি বা শিশুর ঘরে ঢুকে পড়তে পারবে—অক্টোবর ৭ তারিখে ঠিক সেটাই ঘটেছিল।'

যুদ্ধের ২ বছর পর গাজায় বিবিসি।
জীবনে ফেরার চেষ্টা করছেন গাজার বাসিন্দারা। 

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন এবং আরও ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।

গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এরপর থেকে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজারেরও বেশি গাজাবাসী নিহত হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল শোশানি জানান, এই এলাকায় কয়েকজন জিম্মির মরদেহ পাওয়া গেছে, যার মধ্যে এ সপ্তাহে হামাসের ফেরত দেওয়া ইটাই চেনের মরদেহও রয়েছে। আরও ৭ জিম্মির মরদেহের খোঁজ চলছে।

বিবিসির সাংবাদিক যে ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে গিয়েছিলেন, তার অবস্থান ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনায় নির্ধারিত অস্থায়ী সীমা 'হলুদ রেখা' থেকে কয়েকশ মিটার দূরে। যা গাজাকে ইসরায়েলি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ও হামাস নিয়ন্ত্রিত সীমানা হিসেবে ভাগ করে দিয়েছে।

হামাস যোদ্ধা ও সাধারণ নাগরিকদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে ইসরায়েলি সেনারা ধীরে ধীরে মাটিতে ব্লক বসিয়ে সেই 'হলুদ রেখা' চিহ্নিত করে দিচ্ছে।

যুদ্ধের ২ বছর পর গাজায় বিবিসি।
যুদ্ধের প্রায় প্রতিটি দিন মরদেহ দাফন করতে হিমশিম খেতে হয়েছে গাজাবাসীকে। 

যুদ্ধবিরতির প্রায় এক মাস হতে চললেও ইসরায়েলি সেনারা বলছে, তাদের প্রায় প্রতিদিনই হলুদ রেখার পাশে হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। 

হামাসের অভিযোগ, ইসরায়েল শত শতবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে এবং গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি—এর ফলে এখন পর্যন্ত ২৪০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

কর্নেল শোশানি বলেন, 'ইসরায়েলি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন শান্তি পরিকল্পনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে হামাস যাতে ইসরায়েলি নাগরিকদের জন্য আর কোনো হুমকি না হয়, তা নিশ্চিত করতেই তারা যতদিন প্রয়োজন থাকবে।'

যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন শান্তি পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে হামাসকে নিরস্ত্র হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে থাকা এক ফিলিস্তিনি কমিটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পসহ আরও অনেকে।

কিন্তু কর্নেল শোশানির দাবি, ক্ষমতা ও অস্ত্র সমর্পণের বদলে হামাস উল্টো পথেই হাঁটছে।

যুদ্ধের ২ বছর পর গাজায় বিবিসি।
বিস্তীর্ণ এলাকা ছাড়িয়ে গেছে গাজার গণকবর। 

তিনি বলেন, 'হামাস নিজেদের আরও অস্ত্রে সজ্জিত করছে, গাজার ওপর আবারও প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।'

'তারা প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ হত্যা করছে—সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাতে এবং বোঝাতে যে গাজার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে।'

ইসরায়েলি বাহিনী সাংবাদিকদের একটি মানচিত্র দেখায়, যেখানে তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া সুড়ঙ্গগুলোর নকশা দেখায়—তাদের ভাষায়, 'একটি বিশাল সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক, যেন মাকড়সার জাল'—যার কিছু ধ্বংস করা হয়েছে, কিছু এখনো অক্ষত, আর কিছু তারা এখনো খুঁজছে।

এই চুক্তি গাজাকে এক অস্থির ও অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ওয়াশিংটন জানে, পরিস্থিতি কতটা নাজুক—যুদ্ধবিরতি ইতিমধ্যেই দুইবার ভেঙেছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গাজাকে একটি ভবিষ্যতমুখী মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, যা বিদেশি বিনিয়োগে নির্মিত হবে। কিন্তু আজকের গাজা সেই কল্পনার চেয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে।

ইসরায়েলের আক্রমণে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজাকে এখন ট্রাম্পের চোখে বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু মূল প্রশ্ন—এই যুদ্ধ কে থামাবে তা নয়, বরং গাজার মানুষ নিজেদের ভূমি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কতটা কথা বলতে পারবে?

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha